আধুনিক জীবনযাত্রায় নানা রোগের বাসা হয়ে উঠেছে আমাদের শরীর। অজান্তে উচ্চ রক্তচাপ থেকে শুরু উচ্চ কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিসের মতো রোগগুলো একের পর এক অঙ্গের ক্ষতি করে যাচ্ছে। কোলেস্টেরল আর ফ্যাট জমে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে হৃদযন্ত্রের ধমনী, যাকে বলে করোনারি হার্ট ব্লক।
আধুনিক জীবনযাত্রায় নানা রোগের বাসা হয়ে উঠেছে আমাদের শরীর। অজান্তে উচ্চ রক্তচাপ থেকে শুরু উচ্চ কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিসের মতো রোগগুলো একের পর এক অঙ্গের ক্ষতি করে যাচ্ছে। কোলেস্টেরল আর ফ্যাট জমে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে হৃদযন্ত্রের ধমনী, যাকে বলে করোনারি হার্ট ব্লক। এছাড়াও নানা গুরুতর সমস্যা বাসা বাধছে হৃদযন্ত্রে। শরীরের ছোট্ট অথচ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটিকে সারাতে অস্ত্রোপচার করা ছাড়া উপায় থাকছে না। আশার কথা একটাই, যথেষ্ট জটিল ও গুরুতর হওয়া সত্ত্বেও প্রায় ৯৭-৯৮ শতাংশ ক্ষেত্রে সফল হয় ‘ওপেন হার্ট সার্জারি’।
ওপেন হার্ট সার্জারি বা উন্মুক্ত হৃদশল্য চিকিৎসা বলতে বোঝায় হৃদযন্ত্র বা হৃৎপিণ্ডের অস্ত্রোপচার। এক্ষেত্রে বুক উন্মুক্ত করা হয়, হৃৎপিণ্ড নয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে হৃৎপিণ্ড উন্মুক্ত করেও অস্ত্রোপচার হতে পারে। ক্রমাগত রক্ত প্রবাহের জন্য হৃৎপিণ্ডে অস্ত্রোপচার করা দুরূহ হয়ে পড়ে। তাই এই রক্তপ্রবাহ বন্ধ করার জন্য একটা কৃত্রিম পাম্প মেশিনের (হার্ট-লাঙ বাইপাস মেশিন) সাহায্য নেওয়া হয় অস্ত্রোপচার চলাকালীন। এটি সাময়িক রক্ত সংবহনের কাজ করে। সেই সুযোগে স্পন্দনহীন ও রক্তপ্রবাহহীন হৃৎপিণ্ডে অস্ত্রোপচার করা হয়। তবে, এই অবস্থায় বেশিক্ষণ রাখা যায় না বলে দ্রুত অস্ত্রোপচার শেষ করে বাইপাস মেশিনটিকে সরিয়ে ফেলা হয়। বর্তমানে করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্র্যাফটিং বা সিএবিজি পাম্প মেশিন ছাড়াই করা সম্ভব হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে বলে ‘বিটিং হার্ট সার্জারি’।
ওপেন হার্ট সার্জারিতে সবচেয়ে বেশি যে চিকিৎসাটি করা হয়, সেটি হল করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্র্যাফটিং বা সিএবিজি।
হৃৎপিণ্ডে করোনারি আর্টারির একটি নেটওয়ার্ক হৃদপেশীতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পৌঁছে দেয়। এককথায় হৃদপেশীকে সচল রাখে করোনারি আর্টারি। কোলেস্টেরল আর ফ্যাট জমে এই করোনারি আর্টারিতে ‘ব্লক’ হলে হৃদপেশীতে রক্ত সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। যার জেরে পুষ্টি বা অক্সিজেন সরবরাহ কমে বা বন্ধ হয়ে যায় এবং হৃদস্পন্দন ব্যাহত হয়।
হঠাৎ করে করোনারি আর্টারি ব্লক হয়ে গেলে সেখানে রক্ত জমাট বেঁধে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যাকে বলে করোনারি থ্রম্বোসিস। আবার দীর্ঘ দিন ধরে হার্টের আর্টারিতে কোলেস্টেরল জমতে জমতে রক্ত সঞ্চালনে বাধা হতে পারে। ব্লক যত বাড়বে রক্ত সঞ্চালন তত কমবে। একে বলে ক্রনিক হার্ট ব্লক। বুকে ব্যথা, ধড়ফড় ভাব, মাথা ব্যথা ইত্যাদি এর লক্ষ্মণ। এর চিকিৎসা বলতে স্টেন্ট বসিয়ে ব্লক খুলে দেওয়া যায়, যাকে বলে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি। এছাড়া উন্মুক্ত অস্ত্রোপচার বা ওপেন হার্ট সার্জারিতে সুস্থ একটি ধমনী জুড়ে দেওয়া হয় বাধাপ্রাপ্ত ধমনীটির গায়ে। এর ফলে বাধাপ্রাপ্ত ধমনীটিকে ‘বাইপাস’ করে সুস্থ ধমনী দিয়ে রক্ত সরবরাহ সচল থাকে হৃৎপিণ্ডে।
এছাড়াও হৃৎপিণ্ডের ত্রুটিপূর্ণ ভালভ (যে দরজা বা কপাট দিয়ে রক্ত যাতায়াত করে) সারানো বা প্রতিস্থাপনের জন্য উন্মুক্ত অস্ত্রোপচার করা হতে পারে।
অন্যের হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হলে ওপেন হার্ট সার্জারিতে তা করা হয়।
জন্মগত ভাবে হৃৎপিণ্ডের কোনও গঠনগত ত্রুটি থাকলে বা ছিদ্র থাকলে তা সারাতে ওপেন হার্ট সার্জারির প্রয়োজন পড়ে।
ওপেন হার্ট সার্জারির দিনক্ষণ স্থির হয়ে গেলে তার আগে কী করণীয় জানিয়ে দেন চিকিৎসক। সাধারণত রক্ত পাতলা করার ওষুধ কেউ ব্যবহার করলে (অ্যাসপিরিন, ওয়ারফিরিন) তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ননস্টেরয়ডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস বন্ধ রাখতে হয়। সার্জারির নির্দিষ্ট কিছু সময় আগে থেকে উপবাসে থাকতে হয়, যাতে অ্যানাস্থেশিয়া ঠিক মতো কাজ করে। আর অতি অবশ্যই মদ্যপান করা চলে না। বন্ধ রাখতে হয় ধূমপানও। সার্জারির আগে বুকের এক্স-রে ও ইকোকার্ডিওগ্রাম করা হয়। সার্জারির জায়গাটি শোধন করে ব্যাকটেরিয়া মুক্ত করা হয়। অনেকসময় এর জন্য বিশেষ সাবান ব্যবহার করে স্নানের পরামর্শ দেওয়া হয়। একটা আইভি (ইনট্রাভেনাস) চ্যানেল করা হয় তরল ও ওষুধ শরীরে যাওয়ার জন্য।
এই অস্ত্রোপচার অত্যন্ত জটিল এবং প্রায় পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা সময় লাগে। এর বেশিও সময় লাগতে পারে।
১) জেনারেল অ্যানাস্থেশিয়া প্রয়োগ করে প্রথমে অচেতন করা হয় রোগীকে যাতে ঘুমন্ত অবস্থায় যন্ত্রণা ছাড়া অস্ত্রোপচার করা যায়।
২) এরপর প্রয়োজন মতো ৬-৮ ইঞ্চি লম্বা কাটা হয় বুকে।
৩) ব্রেস্টবোন বা বক্ষাস্থি কেটে বুকের খাঁচাকে উন্মুক্ত করা হয় যাতে হৃৎপিণ্ডটি দেখতে পাওয়া যায়।
৪) অন-পাম্প সার্জারি হলে হৃৎপিণ্ডকে হার্ট-লাঙ বাইপাস মেশিনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। অ্যানাস্থেশিওলজিস্ট হৃৎপিণ্ডের গতি বন্ধ করার জন্য ওষুধ দেন এবং মনিটরিং করেন।
৫) অপারেশন হয়ে গেলে হৃৎপিণ্ডে রক্ত সংবহন চালু করা হয়। সাধারণত নিজে থেকেই হৃদস্পন্দন ফিরে আসে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার দরকার হয়।
৬) হৃদস্পন্দন চালু হয়ে গেলেই বাইপাস মেশিনটিকে খুলে ফেলা হয়।
৭) তার দিয়ে কাটা বক্ষাস্থি জোড়া লাগানো হয়। কখনও ছোট টাইটেনিয়াম প্লেট ব্যবহার করা হয় বক্ষাস্থি জোড়া লাগাতে।
৮) সবশেষে বাইরে বুকের ক্ষতস্থান সেলাই করা হয়।
অস্ত্রোপচার কতটা জটিল ছিল তার উপরে নির্ভর করে আইসিইউতে এক দিন না তার বেশি সময় রাখা হবে। বুকের সঙ্গে দুই থেকে তিনটি টিউব লাগানো থাকে হৃৎপিণ্ড থেকে রস নিঃসরণ হলে তা বার করার জন্য। মনিটরে হার্টের গতি দেখা হয়। বিপন্মুক্ত হলে পরে হাসপাতালের সাধারণ শয্যায় স্থানান্তর করা হয় রোগীকে এবং পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।
ওপেন হার্ট সার্জারিতে বুকের ক্ষতের যত্ন নেওয়া খুব জরুরি। ক্ষতস্থান শুকনো রাখতে হবে। রস ক্ষরণ বা কোনও রকম সংক্রমণ হচ্ছে কি না সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ড্রেনেজ টিউব যেগুলো লাগানো হয়েছিল বুকে, সেগুলো অপসারণের সময় (অস্ত্রোপচারের এক দিন পর সাধারণত) ব্যথা লাগে। প্রয়োজন হলে শক্ত বালিশের মতো একটা জিনিস বুকে বেঁধে দেওয়া হয় যাতে হাঁচি কাশি বা নাড়াচাড়াতে ক্ষতস্থানে প্রভাব না পড়ে। অস্ত্রোপচারের পরে ক্ষতস্থানে ব্যাথা থাকা স্বাভাবিক। ব্যাথা নিরোধক ওষুধ নিয়মিত খেতে হবে।
এছাড়াও কোষ্ঠকাঠিন্য, ঘুমের সমস্যা হয়। অনেকের অবসাদ বা অন্যান্য মানসিক সমস্যা গ্রাস করে। এমনকী সাময়িক স্মৃতিভ্রংশও হতে পারে।
অস্ত্রোপচারের পর পুরোপুরি ভাবে সারতে ৬ থেকে ১২ সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় লাগতে পারে। তার আগে কোনও ভারী কাজ বা পরিশ্রমের কাজ করা যায় না।
আর পাঁচটা অস্ত্রোপচারের মতো ওপেন হার্ট সার্জারিতেও কিছু ঝুঁকি থাকে। অত্যধিক মোটা বা যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগ রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা আর একটু বেশি। ধূমপানের অভ্যাস যাদের রয়েছে তাদের ক্ষেত্রেও কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। বস্তুত ফুসফুসের সমস্যা যেমন ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজ়িজ় ইত্যাদিতে ভুগলে অপারেশন পরবর্তী জটিলতার ঝুঁকি থাকে। সাধারণ ভাবে অস্ত্রোপচার থেকে যে সমস্যাগুলি হতে পারে, সেগুলি হল অ্যানেস্থেশিয়া থেকে অ্যালার্জি, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, ক্ষতস্থান থেকে রক্তপাত, সংক্রমণ, কিডনি বা ফুসফুসের ক্ষতি, স্ট্রোক। বুকে ব্যথা বাড়া, জ্বর, শ্বাস নিতে সমস্যা, বমি, মাথা ঘোরা, নিউমেনিয়ার মতো উপসর্গে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। স্ট্রোকের কোনও লক্ষ্মণ দেখা দিল কিনা সেদিকে সচেতন থাকতে হবে।
সামগ্রিকভাবে, ওপেন হার্ট সার্জারি একটি জটিল প্রক্রিয়া। স্বাভাবিকভাবেই সারতে অনেক সময় লাগে। সেই সময় দিন এবং অস্ত্রোপচারের পর কার্ডিওলজিস্ট পরামর্শ খুব সাবধানে মেনে চলুন। সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পর আপনি আপনার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন। কিন্তু সেই জীবনধারা স্বাস্থ্যকর হওয়া উচিত। অর্থাৎ জীবনকে ছন্দে রাখতে হালকা ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম। অ্যালকোহল এবং ধূমপান থেকে দূরে থাকা ভাল। চিকিৎসা বিজ্ঞানের কৃপায় হার্ট বিপদে পড়লেও বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব নিজের উপর।
অস্ত্রোপচারের সময় জ্ঞান থাকে না। কিন্তু চেতনা ফিরে আসার পর ক্ষতস্থানে ব্যথা অনুভব হওয়া স্বাভাবিক। বুকের অন্যদিকে ব্যথা লাগতে পারে। পাশাপাশি ঘাড় ও পিঠের উপরিভাগে ব্যথা হতে পারে। ড্রেনেজ টিউব যেগুলো লাগানো হয়েছিল বুকে, সেগুলো অপসারণের সময় ব্যথা লাগে। ব্যথা যাতে না হয় তার জন্য ওষুধ দেওয়া হবে। সেই ওষুধ নিয়ম করে খেতে হবে। সাধারণত ৪ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে ব্যথা চলে যায়।
হোলগ্রেন খাবার যেমন ব্রাউন ব্রেড, ব্রাউন রাইস, পাস্তা, কিনুয়া, রোলড ওটস, বার্লি ইত্যাদি খেতে হবে। ফ্যাটযুক্ত খাবার যতটা সম্ভব কম খাবে। এমনকী দুধও লো-ফ্যাট যেন হয়। হেলদি ফ্যাটের জন্য বাদাম, অ্যাভোক্যাডো ইত্যাদি খাওয়া যাবে। বাটার, ঘি, ক্রিম, কেক, বিস্কুট ইত্যাদি একেবারে খাওয়া যাবে না। প্রক্রিয়াজাত মাংস যেমন সসেজ বা এই ধরনের খাবার খাওয়া চলবে না। ফ্যাটযুক্ত, প্রক্রিয়াজাত, হিমায়িত অস্বাস্থ্যকর খাবার অস্ত্রোপচারের পরে নতুন করে জটিলতা ডেকে আনতে পারে।
হৃদযন্ত্রের সমস্যা মানেই যে বুক কেটে অস্ত্রোপচার করতে হবে এমনটা নয়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে কম কাটাছেঁড়া করে হৃদযন্ত্রের অনেক সমস্যার অস্ত্রোপচার সম্ভব। যেমন, ক্যাথিটারের সাহায্য নিয়ে ট্রান্সক্যাথিটার অ্যাওর্টিক ভালভ রিপ্লেসমেন্ট, করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি অ্যান্ড স্টেন্টিং করা যায়। ভিএটিএস বা ভিডিও অ্যাসিসটেড থোরাসিস সার্জারিতে ছোট ছোট কয়েকটা ছিদ্র করে সেখান দিয়ে ভিডিও ক্যামেরা ও শল্যযন্ত্র ভিতরে ঢুকিয়ে অস্ত্রোপচার করা হয়। ভালভুলার হার্ট ডিজ়িজ়, কার্ডিয়াক টিউমার, অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন এবং হৃৎপিণ্ডে ছিদ্র থাকার মতো সমস্যাগুলি রোবটিক্যালি অ্যাসিস্টেড পদ্ধতিতে কম কেটে অস্ত্রোপচারে সারানো সম্ভব।
Written and Verified by:
Dr. Ratan Kumar Das is the Director of Cardiothoracic & Vascular Surgery Dept. at BM Birla Heart Hospital, Kolkata, with over 20 years of experience. He specializes in off-pump CABG with LIMA-RIMA Y, minimally invasive valve surgery, mitral valve repair, and pediatric cardiac surgery.
© 2024 BMB Kolkata. All Rights Reserved.