Enquire now
Enquire NowCall Back Whatsapp
শীতকালে হার্ট অ্যাটাক কেন বেশি হয়

Home > Blogs > শীতকালে হার্ট অ্যাটাক কেন বেশি হয়

শীতকালে হার্ট অ্যাটাক কেন বেশি হয়

Cardiology | by Dr. Anil Mishra | Published on 08/05/2023


এক কথায় হার্ট অ্যাটাক হল মৃত্যুর দূত। প্রাণ যদি রক্ষাও হয়, শরীরের ক্ষতি আর চিকিৎসার পিছনে বিপুল খরচ এড়ানো যায় না। আধুনিক জীবনযাত্রায় হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে। শুধু বয়স্করাই নয়, এখন চল্লিশের কোঠায়, এমনকী ছোটদেরও হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে। ভোররাতে বা সকালবেলা, বিশেষ করে শীতকালে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে। কেন এমনটা হয় জানতে চাইলে সবার আগে রোগটির কারণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে হবে।

হার্ট অ্যাটাক কী ?

চিকিৎসার পরিভাষায় হার্ট অ্যাটাকের নাম মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক অবস্থা যা হৃৎপিণ্ডে রক্ত সরবরাহ বন্ধ বা বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে তৈরি হয়। আমাদের শরীরের অন্যান্য অংশের মতো হৃদপেশীকেও সচল রাখার জন্য পুষ্টি বা অক্সিজেন সরবরাহের দরকার হয়। করোনারি আর্টারি নামে ধমনীর একটি নেটওয়ার্ক এই পুষ্টি যোগায় হৃৎপিণ্ড বা হৃদপেশীকে। মেদ ও কোলেস্টেরলের অধঃক্ষেপ (প্লাক) জমে করোনারি আর্টারির এক বা একাধিক জায়গায় ব্লক হলে, সংশ্লিষ্ট হৃদপেশীতে রক্তপ্রবাহ কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে পুষ্টির অভাবে ওই হৃদপেশী ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। যার জেরে হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হতে পারে, এমনকী থেমেও যেতে পারে। দ্রুত ওই ব্লক সরিয়ে হৃৎপিণ্ডে রক্তপ্রবাহ ঠিক করতে না পারলে শিয়রে শমন।

হার্ট অ্যাটাক কেন হয় ?

করোনারি আর্টারিতে তেলচিটে উপাদান (প্লাক) জমার ফলে (আথারোস্ক্লেরোসিস) হৃদপেশীতে রক্ত সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত বা বিঘ্নিত হয়। অক্সিজেনের অভাবে হৃদপেশী কাজ করা বন্ধ করে দিলে বা ঠিক ভাবে কাজ করতে না পারলে হার্ট অ্যাটাক হয়। অনেকসময় এই প্লাক অধঃক্ষেপের জায়গাটিতে রক্ত জমাট হয়ে পুরোপুরি ব্লকেজ হয়ে যায়। 

খুব কম ক্ষেত্রে (৫ শতাংশ বড়জোর) কোনও রকম ব্লকেজ ছাড়াও হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। যেমন, অন্য কোথাও রক্ত জমাট বেধে বা বুদবুদ (বাবল) তৈরি হওয়ার পর তা করোনারি আর্টারিতে এসে আটকে একই সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। করোনারি আর্টারিতে কোনও কারণে ক্ষত বা কোনও জায়গা পেকে গিয়ে বিপদ হতে পারে। ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স থেকে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। করোনারি আর্টারি স্প্যাজমের (সঙ্কুচিত হওয়া বা খিঁচ ধরা) কারণে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। গভীর রাতে বা ভোরবেলা হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পিছনে অন্যতম কারণ, করোনারি আর্টারি স্প্যাজম। শীতের ঠান্ডাতেও এই পরিস্থিতি হতে পারে।

দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ বা খুব বেশি মানসিক চাপে থাকলে শরীরে স্ট্রেস হরমোন, যেমন অ্যাড্রিনালিন, নরঅ্যাড্রিনালিন, এপিনেফ্রাইন, নরএপিনেফ্রাইনের ক্ষরণ বেড়ে যায় যা হৃদপেশীর কার্যক্ষমতাকে প্রভাবিত করে হৃদস্পন্দন অনিয়মিত করে দেয়। একে বলে ব্রোকেন হার্ট সিনড্রোম। মেয়েদের বিশেষ করে বয়স্ক মহিলাদের এই সমস্যা বেশি হয়। এটি অবশ্য তুলনায় কম গুরুতর অবস্থা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেরে যায়। এছাড়া জন্মগত ভাবে কারও হৃদযন্ত্রে যদি করোনারি আর্টারিগুলি অস্বাভাবিক অবস্থানে থাকে (অ্যানোমালাস করোনারি আর্টারিজ়), তখন রক্ত প্রবাহে সমস্যা থেকে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।

শীতকালে হার্ট অ্যাটাক কেন বেশি হয় ?

শীতকালে হার্ট অ্যাটাকের ঘটনা তুলনায় বেশি হয়। এর পিছনে কিছু কারণ আছে। এমনিতে এই সময় শরীরের ভিতরের তাপমাত্রা বজায় রাখার জন্য হৃৎপিণ্ডকে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। হৃদযন্ত্র দুর্বল থাকলে বেশি পরিশ্রম করতে গিয়ে সমস্যা হয়। তখন শরীর ঠান্ডা হয়ে গিয়ে দেখা দিতে পারে হাইপোথার্মিয়া। এর ফলে হৃদপেশীর ক্ষতি হয় যা থেকে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে। আর একটি কারণ হল, শীতের ঠান্ডায় শরীরের রক্তবাহী নালী সঙ্কুচিত হওয়ার ফলে রক্ত চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়। হার্টের করোনারি আর্টারিতে এই কারণে রক্ত চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হলে হৃদপেশীতে অক্সিজেন সরবরাহ কম বা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে হৃদপেশী ঠিক ভাবে কাজ করতে না পারলে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।

কাদের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ?

হার্ট অ্যাটাকের সঙ্গে বয়স ও লিঙ্গের একটা সম্পর্ক রয়েছে। ৪৫-এর বেশি বয়সী পুরুষ ও ৫৫-র বেশি বয়সী মহিলাদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে বংশে বাবা বা ভাইয়ের যদি ৫৫ বা তার চেয়েও কম বয়সে হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকার ইতিহাস থাকে কিংবা মা বা বোনের ৬৫-র কম বয়সে হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে, তাহলে এই রোগের ঝুঁকি বাড়ে। সারাদিন এক জায়গায় বসে কাজ করে যারা, তারা যদি অন্য সময়ে হাঁটাচলা বা শরীরচর্চা না করে তাহলে এই রোগের ঝুঁকি থাকে। সোডিয়াম, সুগার আর ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার বেশি খেলে প্লাক ডিপোজিটের ঝুঁকি বাড়ে। ধূমপান, মদ্যপান দুটোই হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্যের পক্ষে খুব খারাপ। ডায়াবেটিস, স্থুলত্ব, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরলে ভুগলে তার প্রভাব পড়ে করোনারি আর্টারি ব্লকে।

হার্ট অ্যাটাকের লক্ষ্মণ

হার্ট অ্যাটাকের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্মণ হল বুকে ব্যাথা। ব্যথাটা ক্রমশ বাড়তে থাকে। বুক থেকে ব্যথা হাত, ঘাড়, গলা, চোয়াল পর্যন্ত উঠে আসে। অস্বস্তি বা দম ফুরিয়ে যাওয়া এর আর একটা লক্ষ্মণ। তার সঙ্গে মাথা ব্যথা, ক্লান্তি, ঘুমোতে সমস্যা, পেটে অস্বস্তি, জ্বালাভাব, বুক ধড়ফড় করা, অত্যাধিক ঘামের মতো লক্ষ্মণগুলো থাকবে। অনেকসময় এত কিছু লক্ষ্মণ শরীরে জানান দেয় না। একে বলে সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক। একটা মৃদু অস্বস্তি, দম চাপা ভাব, যেন পেটে গ্যাস হয়েছে এমনটা মনে হয়।

হার্ট অ্যাটাক হলে কী করণীয় ?

হার্ট অ্যাটাকের লক্ষ্মণ দেখা দিলে রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব কাছের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, যেখানে এর চিকিৎসা হয়। দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা দরকার। দেরি হলে আরও বড় সমস্যা হতে পারে। তাই বুকে ব্যথার সঙ্গে ধড়ফড় ভাব, অস্বস্তি, ঘাম দেওয়ার মতো উপসর্গ হলে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুল্যান্স ডাকতে হবে। সেরে যাবে ভেবে গড়িমসি করা বা নিজে একা হাসপাতালে যাওয়ার মতো বোকামি করা চলবে না। বিশেষ করে নিজে গাড়ি চালিয়ে একেবারেই যাওয়া উচিত নয়।

হার্ট অ্যাটাক নির্ণয়

নাড়ি পরীক্ষা, রক্তে অক্সিজেন লেভেল ও রক্তচাপ মেপে, চিকিৎসক  কিছুটা আন্দাজ পাবেন। রোগীর উপসর্গ ও শরীরবৃত্তীয় ইতিহাস জানার পরে রক্ত পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়। সাধারণত হার্ট অ্যাটাকের সময় হৃদপেশীর কোষে যে ক্ষতি হয় তার একটা কেমিক্যাল মার্ক (কার্ডিয়াক ট্রোপোনিন) রক্তে পাওয়া যায়। এছাড়া আলট্রাসাউন্ডের সাহায্যে ইকোকার্ডিওগ্রাম করা হয়। অ্যাঞ্জিওগ্রাম করে কোনও জায়গায় রক্তপ্রবাহ বন্ধ আছে কিনা দেখা হয়। সিটি স্ক্যান ও এমআরআই করে হৃদযন্ত্রের আরও বিস্তারিত ছবি পাওয়া যায়। প্রয়োজনে কার্ডিওলজি ডাক্তার হার্টের নিউক্লিয়ার স্ক্যান করতেও বলতে পারেন।

হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা

চিকিৎসা বলতে সবার আগে হৃদপেশীতে রক্ত সরবরাহ ঠিক করার চেষ্টা করা হয়। এটা নানা ভাবে করা যেতে পারে। রক্ত পাতলা করার ওষুধ (অ্যান্টি-ক্লটিং) দিয়ে, নাইট্রোগ্লিসারিন (ব্লাড ভেসেল প্রসারিত) দিয়ে কিংবা থ্রম্বোলাইটিক (ক্লট-বাস্টিং) দিয়ে। হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক করার জন্য ওষুধ দেওয়া হয় অ্যারিদমিয়ার ক্ষেত্রে। এছাড়া বুকের ব্যথা কমানোর জন্য মরফিন দেওয়া হয়। 

হৃদপেশীতে রক্ত সরবরাহ স্বাভাবিক করার জন্য পিসিআই (পারকিউটেনিয়াস করোনারি ইনটারভেনশন) পদ্ধতিতে একটা ক্যাথিটারের মতো যন্ত্রের সাহায্যে স্টেন্ট বসিয়ে ব্লকেজ দূর করা যায়। করোনারি আর্টারিতে অনেকগুলো ব্লকেজ থাকলে করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্র্যাফটিং (সিএবিজি) পদ্ধতিতে শরীরের অন্য জায়গা থেকে ধমনী নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ধমনীটিকে বাইপাস করে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক করা হয়। 

চিকিৎসার ধরনের উপরে নির্ভর করে সুস্থ হতে কতটা সময় লাগবে। পিসিআই-এর ক্ষেত্রে চার দিনেই হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিতে পারে। সিএবিজি বা ওপেন হার্ট সার্জারিতে কম করে সাত দিন বা তারও বেশি সময় লাগে। পুরোপুরি ভাবে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরতে দুই থেকে তিন মাস সময় লেগে যায়।

সবশেষে বলা যায়, হৃদযন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার জের বইতে হয় জীবনভর। তাই হৃদযন্ত্র যাতে সুস্থ থাকে তার জন্য আগে থেকেই সতর্ক থাকা দরকার। স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, হালকা শরীরচর্চা, পর্যাপ্ত ঘুম ও উদ্বেগহীন জীবন হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখে। প্রক্রিয়াজাত, হিমায়িত খাবার, মদ্যপান ও ধূমপান থেকে দূরে থাকতে হবে। নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা করে দেখে নিতে হবে অজান্তে কোনও রোগ বাসা বাধছে কি না। 

বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্নমালা

 

১) হার্ট অ্যাটাক থেকে শরীরে কী ধরনের জটিলতা হতে পারে?

হার্ট অ্যাটাকের পরে শরীরে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। হার্ট ব্লক, সাডেন কার্ডিয়াক ডেথ, পালমোনারি ইডেমা, অ্যারিদমিয়া-সহ স্বল্পমেয়াদি জটিলতার পাশাপাশি কিডনির সমস্যা, ভালভের সমস্যা এমনকী হার্ট ফেলিওর হতে পারে।

২) স্মল অ্যাটাক কি?

স্মল হার্ট অ্যাটাক বা মিনি হার্ট অ্যাটাক হল হার্ট অ্যাটাকের কম গুরুতর একটা সংস্করণ। এক্ষেত্রে করোনারি আর্টারিতে আংশিক ব্লকেজ হয়, যার জন্য রক্ত সংবহনে বাধা পরে, কিন্তু একেবারে থেমে যায় না। অর্থাৎ হৃদযন্ত্রে তুলনায় কম ক্ষতি হয়।

৩) হার্ট ভাল রাখার জন্য কোন ব্যায়াম করা উচিত?

হার্ট ভাল রাখার জন্য প্রতি দিন কম করে আধ ঘণ্টা দ্রুত হাঁটার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। দৌড়নো, সাঁতার কাটা বা সাইকেল চালিয়েও ভাল ফল পাওয়া যায়। এককথায়, হার্ট পাম্পিং অ্যারোবিক এক্সারসাইজ করলে উপকার হয়। পেশীর শক্তি বাড়ানোর জন্য হালকা ওয়েট লিফটিং করে উপকার পাওয়া যায়। রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, রক্তে শর্করার পরিমাণ, সর্বোপরি ওজন নিয়ন্ত্রণে যোগব্যায়াম যথেষ্ট কার্যকরী। প্রাণায়াম অভ্যাস করে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ বা দম বাড়ানোর কৌশল রপ্ত হয়, যা হৃদযন্ত্রকে মজবুত করে।

৪) সকালে হার্ট অ্যাটাক কেন হয়?

ভোর ৪টে থেকে সকাল ১০টার মধ্যে হার্ট অ্যটাক হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। এই সময় অ্যাড্রিনালিন গ্রন্থি থেকে অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ বেড়ে যাওয়ার ফলে করোনারি ধমনীতে চাপ সৃষ্টি হয়। এছাড়া সকালবেলা রক্তের পিআই-১ কোষগুলি বেশি সক্রিয় থাকে। এর ফলে রক্ত জমাট বাঁধতে সুবিধা হয়, যেখান থেকে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। ভোরের দিকে শরীরে সাইটোকিনিন হরমোন নিঃসরণ সবচেয়ে বেশি হয়। হৃদযন্ত্র এর জন্য প্রস্তুত না থাকলে অ্যারিদমিয়া বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন থেকে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থাকে।