Enquire now
Enquire NowCall Back Whatsapp
করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি:পদ্ধতি ও ঝুঁকি

Home > Blogs > করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি:পদ্ধতি ও ঝুঁকি

করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি:পদ্ধতি ও ঝুঁকি

Cardiology | by Dr. Anjan Siotia | Published on 09/05/2023


Table of Contents

অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি শব্দটি একটি চিকিৎসা জনিত পরিভাষা।যদি এর আক্ষরিক অর্থ করা যায় তাহলে বলতে হয় চিকিৎসা জগতে এটা এমন একটা পদ্ধতি যেখানে বেলুনের সাহায্যে কোনো সংকীর্ণ নালিপথকে খুলে দেওয়া হয়।একটি ক্ষুদ্র বেলুন ক্যাথিটারের সাথে যুক্ত করে রুদ্ধ হয়ে যাওয়া রক্তবাহে প্রবেশ করানো হয় এবং ব্লকেজ খুলে দিয়ে হৃদপিন্ডে রক্ত প্রবাহ সাবলিল করে তোলা হয়।

করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি

করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হল একটি থেরাপটিক পদ্ধতি যেখানে সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া (স্টেনোটিক) করোনারি আর্টারির চিকিৎসা করা হয়। এটি করোনারি হার্ট ডিজিজের অন্তর্ভুক্ত। এই হৃদ-ধমনীর ব্লকেজের কারণ হল কোলেস্টেরল। রক্তবাহে বিশেষত ধমনীতে কোলেস্টেরল প্লাক তৈরী করে যেগুলো ধমনীর অভ্যন্তরের গহ্বরের ব্যাস কমিয়ে দেওয়ার জন্য দায়ী।এই ঘটনাকে অ্যাথেরোস্কেলেরোসিস বলে।

করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি  করার দরকার কখন পরে?

নিম্নোলিখিত ক্ষেত্রগুলিতে করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

  • আনস্টেবল অ্যানজিনা: এইটি একধরনের অ্যানজিনা পেকটরিস যা অনিয়মিত হয়ে থাকে।
  • এন-এস-টি-এম-আই: এটি হল নন এস-টি মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন। যা সাধারণ হার্ট অ্যাটাক নামে পরিচিত।
  • এস-টি-এম-আই (স্টেমি): এটা হল এস-টি মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন।যা কিনা আগেরটির থেকেও তীব্র হয়ে থাকে। ইলেক্ট্রোকার্ডিগ্রাফের এস-টি এলিভেশনের উপর ভিত্তি করে এই দু ধরনের মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন বিভাগ করা হয়েছে। যাই হোক দুটি ক্ষেত্রেই হৃদপেশীর ক্ষতি সাধন হয়।

করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করতে হবে কিনা কি কি পরীক্ষার মাধ্যমে বুঝবেন?

আপনার বুকে ব্যাথা, বা বুক ধড়ফড় করলে, অথবা কোনো রকম অস্বস্তি অনুভব করলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন। উনি আপনাকে কতকগুলি রক্ত পরীক্ষা, ইসিজি (ইলেক্ট্রোকার্ডিগ্রাম) এবং বুকের এক্স-রে করতে দেবেন। এগুলির ওপর ভিত্তি করে তিনি যদি বোঝেন যে আপনার অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির প্রয়োজন আছে, তাহলে নিশ্চিত হওয়ার জন্য অ্যাঞ্জিওগ্রাম করাবেন। এই ছবি থেকে তিনি বুঝতে পারবেন আপনার করোনারি আর্টারির কোথায় ব্লকেজ হয়েছে।এবং সেটি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির সাহায্যে সেরে যাবে কিনা।

করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করার আগের প্রস্তুতি 

  • আপনার ডাক্তারবাবু যখন আপনার করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করবেন বলে নিশ্চিত হবেন তখন তিনি আপনাকে কতকগুলো নির্দেশ দেবেন। যেমন কিছুদিন আগে থেকে অ্যাস্পিরিন জাতীয় ওষুধ সেবন বন্ধ করতে বলবেন।
  • রক্ত পাতলা রাখে এমন ওষুধ খেতেও আপনাকে নিষেধ করবেন। আপনি যে সমস্ত ওষুধ খান সেগুলোর কথা অবশ্যই আপনার ডাক্তার বাবুকে জানাবেন।
  • করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করার ছয় থেকে আট ঘন্টা আগে থেকেই সমস্ত রকম খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেবেন ডাক্তারবাবু। 
  • প্রয়োজনীয় ওষুধ স্বল্প জল দিয়ে খেতে হবে।

কিভাবে করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করা হয় ?

  • করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করার সময় সাধারণত লোকাল অ্যানাস্থেসিয়া ব্যবহার করা হয়। এর ফলে আপনি এই প্রক্রিয়া চলাকালীন সজাগ থাকবেন। 
  • এরপর একটি সরু নমনীয় তার (ক্যাথিটার) ধমনী বা আর্টারির মধ্য দিয়ে প্রবেশ করানো হয়। ক্যাথিটার সাধারনত বাহু, কব্জি অথবা কুঁচকিতে ফুটো করে ধমনীতে ঢোকানো হয়। সেখানে ক্যাথিটারের গতিপথ এক্স-রে গাইডেড ভিডিও দ্বারা লক্ষ্য করা হয়।
  • যখন ক্যাথিটার ধমনীর ব্লকেজের জায়গায় পৌঁছয়ে, তখন সেটা থেকে একটা বেলুন আক্রান্ত স্থানে পৌঁছে যায়। তারপর বেলুনটিকে ফুলিয়ে, ব্লক হয়ে যাওয়া অংশটাকে চওড়া করা হয়।
  • এরপর যখন ডিফ্ল্যাটেড বেলুন টিকে বার করে আনা হয়, তখন ধমনীর ভিতরে লেগে থাকা ফ্যাট সরে গিয়ে ধমনীর মধ্য দিয়ে রক্ত বাঁধাহীন ভাবে প্রবাহিত হতে থাকে।
  • আর যখন স্টেন্ট বসানো হয় তখন সেটিকে বেলুনের চারধারে ভাল করে লাগানো হয় ধমনীতে প্রবেশ করানোর আগে। স্টেন্টটিও বিস্তৃত হয় যখন বেলুনটাকে ফোলানো হয়। স্টেন্টটিকে নির্দিষ্ট জায়গায় বসানোর পর বেলুনটিকে ডিফ্ল্যাটেড বা চুপসিয়ে নিয়ে বের করে আনা হয়। এইভাবে স্টেন্ট ক্ষতিগ্রস্থ ধমনীর অংশে বসে যায় এবং তার মধ্য দিয়ে অবাধে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে।

এখন জানা যাক স্টেন্ট কি ?

ধাতু, ফ্যাব্রিক, সিলিকন বা বিভিন্ন পদার্থের মিশ্রনের দ্বারা তৈরী করা সরু টিউবের মত একপ্রকার জালক হল স্টেন্ট। সাধারনত করোনারি আর্টারিতে ধাতব স্টেন্ট, বড় ধমনীতে (যেমন অ্যাওর্টাতে) ফ্যাব্রিক, এবং শ্বাসনালীতে সিলিকনের স্টেন্ট বসানো হয়। তবে স্টেইনলেস স্টীলের তৈরী স্টেন্ট হল সব থেকে ভাল। কারণ এটি এক্স-রেতে খুব ভালভাবে দৃশ্যমান হয়। এর স্থিতিস্থাপকতাও খুব উন্নত মানের এবং দারুণ বায়োকমপার্টেবল। এটা চুপসে যাওয়া ধমনীতে খুব ভাল কাজ করে।

করোনারি স্টেন্টের প্রকারভেদ

  • বি-এম-এস বা বেয়ার মেটাল স্টেন্ট হল প্রথম জেনারেশন স্টেন্ট। এই স্টেন্টগুলি ধমনীর চুপসে যাওয়া থেকে সুরক্ষা প্রদান করে। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে আক্রান্ত জায়গায় আবার ব্লকেজের সমস্যা ফিরে আসে কয়েক মাস পর থেকেই।
  • ডি-ই-এস বা ড্রাগ-ইলুটিং স্টেন্ট হল এমন একধরনের স্টেন্ট যা ধীরে ধীরে ড্রাগ রিলিজ করে যেটি সেল পলিফিরেশন বন্ধ করে। এর ফলে ফাইব্রোসিস হয় না যা ব্লাড ক্লটের সাথে যুক্ত হয়ে রিস্টেনোসিস এর সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে।

করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করতে কত সময় লাগে ?

করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করতে মোটামুটি 30 মিনিট থেকে 2 ঘন্টা মতো সময় লাগতে পারে। যদি আপনার শুধুমাত্র অ্যানজাইনার জন্য করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করা হয় তাহলে আপনি সেই দিনেই বা তার পরের দিনেই বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন। কিন্তু যদি হার্ট অ্যাটাকের জন্য করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করা হয় তাহলে সেক্ষেত্রে আপনাকে আরও কয়েক দিন হাসপাতালে থাকতে হতে পারে।

করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির ঝুঁকি

 প্রতিটি অস্ত্রোপচারেই কিছু না কিছু ঝুঁকি থাকে সেটা যত ছোটখাটো অস্ত্রোপচারই হোক না কেন।সেরকমই করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টিতেও নিম্নলিখিত ঝুঁকিগুলি থেকে যায়- 

  • যেস্থানে ছিদ্র করা হয় সেখানে থেকে রক্তক্ষরণ ও লাল হয়ে ফুলে যাওয়া । 
  • অ্যারিথিমা বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন। 
  • রক্তবাহ,ধমনী কিম্বা হার্টের ভালভের ক্ষতি হতে পারে। যদিও তার সম্ভবনা খুবই কম। 
  • হার্ট অ্যাটাক । 
  • বৃক্ক বা কিডনির সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে যাদের আগের থেকে কিডনির সমস্যা আছে তা আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে। 
  • সংক্রমন বা ইনফেকশান।
  • ফরেন বডি রিফিউশাল-দেখা গেছে অনেক সময় স্টেন্টটি আপনার দেহের অনাক্রমত্যার সাথে মানিয়ে নিতে পারেনি, সেক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি হয়। তখন দ্রুত স্টেন্টটি বের করে নিয়ে অন্য ভাবে চিকিৎসা করা হয়।

করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করানোর ফলে কি উপকার পাওয়া যায়?

  • এটা দেখা গেছে হার্ট আটাকের পরে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির দ্বারা অনেক মানুষের জীবন রক্ষা হয়েছে।
  • যত দ্রুত ডাক্তারবাবু আপনার করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করবেন, তত তাড়াতাড়ি আপনার হৃদপিন্ডে রক্ত সংবহন সঠিক মাত্রায় ফিরে আসবে ফলে হৃদপেশির ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমে যাবে।
  • এটি বুকে ব্যাথা কমিয়ে দিতে সাহায্য করে।
  • এটা শ্বাসকষ্ট কমায়।
  • ওপেন হার্ট সার্জারিতে ঝুঁকি বেশি এবং অস্ত্রোপচারের পরবর্তী কালে সেরে উঠতে করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির তুলনায় অনেক সময় লাগে।
  •  দেখা গেছে করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি পরবর্তী হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা অনেকটা কমিয়ে দেয়।

এখন মনে আসতে পারে যে করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির খরচ কেমন?

আমাদের দেশে করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির করতে খরচ মোটামুটি ১.৫ লক্ষ টাকা থেকে ১.৬ লক্ষ টাকা হয়ে থাকে। তবে রোগীর শারীরিক অবস্থা এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর নির্ভর করে খরচের পরিমাণ কিছু কম বেশি হতে পারে।

করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির বিকল্প কি হতে পারে?

এক্ষেত্রে, করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফটিং (সাধারণত বাইপাস সার্জারি নামে প্রচলিত), করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির বিকল্প হতে পারে। তবে সেটার জন্য ব্লকেজ অনেকটা বেশি থাকতে হয়। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের ওষুধ যেমন অ্যান্টিপ্লেটলেট ড্রাগ দিয়ে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনাকে কিছুটা কমানো যেতে পারে। স্ট্যাটিন জাতীয় ওষুধ কোলেস্টেরল কমায় এবং ব্লাড প্রেসার কমাতে বিটা ব্লকার ভাল কাজ দেয়। তবে সব ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারবাবুর নির্দেশ মেনে ওষুধ খাওয়া উচিৎ।

 অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি এবং বাইপাস সার্জারির মধ্যে পার্থক্য কি?

এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখা ভাল যে, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি এবং বাইপাস সার্জারি দুটোই করোনারি আর্টারি ডিজিজের চিকিৎসার পদ্ধতি। রোগীর শারীরিক অবস্থা এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর নির্ভর করেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারবাবু আপনার জন্য কোন পদ্ধতিটি প্রযোজ্য হবে সেটি নির্ধারণ করে থাকেন।

দেখা গেছে যখন আর্টারিতে অনেকগুলো ব্লকেজ থাকে অথবা অনেকটা লম্বা জায়গা জুড়ে ব্লকেজটি অবস্থান করে, সেক্ষেত্রে অন্যান্য অসুবিধা না থাকলে ডাক্তারবাবু বাইপাস করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। বাম মূল ধমনীতে ব্লকেজ থাকলে তার বাইপাস সার্জারি করাই ভাল বলে ডাক্তাররা মনে করেন। তবে বয়স্ক মানুষ এবং দুর্বল রোগীদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। আবার ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির থেকে বাইপাস অনেক বেশি সুবিধাজনক। 

অন্যদিকে আপনার যদি কম সংখ্যক ব্লকেজ থাকে এবং অন্য কোন সমস্যা না থাকে তাহলে করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করার পরামর্শ ডাক্তারবাবু দিতে পারেন। আবার অনেক সময় যখন রোগীর দ্রুত কাজে যোগ দানের ব্যাপার থাকে সেক্ষেত্রে করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি খুবই সহায়ক।

বাইপাস সার্জারির থেকে করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির রিকভারি টাইম কম হওয়ার কারণে অনেকে এটাকে বেশি পছন্দ করেন। তবে দুই ক্ষেত্রেই ডাক্তারবাবুর সিদ্ধান্তই শেষ কথা হওয়া উচিৎ। 

আপনার স্বাস্থ্যই হল আপনার বড় সম্পদ। তাই তাকে অবহেলা নয়, বরং সমস্যা দেখা মাত্র সঠিক সময়ে ডাক্তার দেখিয়ে তাদের পরামর্শ মেনে সঠিক চিকিৎসা করানোর পাশাপাশি নিজের প্রতি কিছুটা যত্নই আপনাকে এক সুস্থ দীর্ঘ জীবনের আশীর্বাদ এনে দিতে পারে।