Enquire now
Enquire NowCall Back Whatsapp Lab report/login
নিউমোনিয়া: কেন হয়, লক্ষণ কী, আর হলে কী করবেন?

Home > Blogs > নিউমোনিয়া: কেন হয়, লক্ষণ কী, আর হলে কী করবেন?

নিউমোনিয়া: কেন হয়, লক্ষণ কী, আর হলে কী করবেন?

Pulmonology | by Dr. Shyam Krishnan | Published on 18/04/2023



নিমোনিয়া কি?

নিউমোনিয়া হল এক ধরণের ফুসফুসের প্রদাহ। আমাদের ফুসফুসের আলভিওলি বা ছোট ছোট বায়ু থলিতে জীবাণুর সংক্রমণের ফলে এই প্রদাহের সৃষ্টি হয়। প্রতি বছর পৃথিবীতে লক্ষাধিক মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন। তার মধ্যে প্রায় শতকরা 23 জন ভারতবর্ষে থেকে। বিশেষত শীতকালে শিশু এবং বয়স্কদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যু হার প্রায় 14 থেকে 30%। তাই আমাদের জানতে হবে কি ভাবে এই রোগ থেকে দূরে থাকা যায়, প্রতিরোধ করা যায় এবং দ্রুত নিরাময় করা যায়।

নিউমোনিয়ার লক্ষণ

যে কোন রোগের লক্ষণ জানা থাকলে সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া অনেক সহজ হয়। নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য। এই লক্ষণগুলি সংক্রমণের পরে ধীরে ধীরে শরীরে প্রকাশ পেতে পারে।

  • কাশি এবং তার সাথে হলুদ বা সবুজ রঙের শ্লেষ্মা (কফ্)। 
  • শ্বাস প্রশ্বাসে কষ্ট। 
  • শ্বাস নেওয়া বা কাশির সময় বুকে ব্যাথার অনুভূতি। 
  • শ্বাস নেওয়ার সময় বুকের ভেতরে ঘরঘর আওয়াজ।
  • শরীরে উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর (103 F বা 39.4 C এর অপর)।
  • বুকে ব্যথা অনুভব করা।
  • সারা শরীরে ব্যথা অনুভূত।
  • ক্লান্তি।
  • খাবারের অরুচি।
  • টানা 3 সপ্তাহের বেশি কাশি হওয়া। 
  • কাশির সঙ্গে রক্তপাত।
  • ফ্যাকাসে নীল শিরার দাগ দেখা যাওয়া। 

এর মধ্যে একাধিক লক্ষণ দেখা গেলেই চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত। নিউমোনিয়ায় সর্বাধিক যে উপসর্গ গুলি দেখা যায় সে গুলি হোল কাশি (79–91%), জ্বর (71–75%) এবং ক্লান্তি(90%)।

নিউমোনিয়া হওয়ার কারণ

বিভিন্ন জীবাণু নিউমোনিয়ার কারণ হতে পারে। তাদের মধ্যে বায়ু-বাহিত ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস অগ্রগণ্য। আমাদের শরীরর স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সাধারণত এই জীবাণু দের থেকে আমাদের রক্ষা করে। কিন্তু কোন কারণে আমাদের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা দুর্বল হলে, সংক্রমণ হয়। এরফলে ফুসফুস ফুলে যায় এবং সেখান থেকে তরল শ্লেষ্মা (mucus) বের হয়। 

প্রধান প্রধান নিউমোনিয়া সৃষ্টি কারক জীবাণু হোল - 

  • স্ত্রেপটোক্ককাস নিউমোনিয়া ব্যাকটেরিয়া প্রায় শতকরা 50 টি নিউমোনিয়ার কারন। - এই ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ সরাসরি হতে পারে। আবার সাধারণ সর্দি এবং ফ্লু-র পর এই ধরনের ব্যাকটেরিয়া শরীরে বাসা বাঁধতে পারে। 
  • অন্যান্য নিউমোনিয়া সংক্রামক ব্যাকটেরিয়া হোল - হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা, ক্লামিদোফিলিয়া নিউমোনিই, লেজিওল্লা নিমফিলিয়া এবং মরাক্সেল্লা কাতারহালিস। অতিরিক্ত মদ্যপানে অভ্যস্ত ব্যক্তিদের নিউমোনিয়া ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি হয়। 
  • ব্যাকটেরিয়ার মতন জীবাণু যেমন মাইকোপ্লাসম নিউমোনিই (Mycoplasma pneumoniae) থেকেও ফুসফুসে সংক্রমণ হতে পারে। 
  • ভাইরাসের কারণে সাধারণত প্রায় একতৃতীয়াংশ নিউমোনিয়ার সংক্রমণ হয়। সর্বাধিক নিউমোনিয়া-কারক ভাইরাস হোল - রাইনোভাইরাস, করোনা ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, রেস্পিরেটোরি সিঙ্কসাইটাল ভাইরাস, আডেনো ভাইরাস ইত্যাদি। অঙ্গ প্রতিস্থাপন এবং দুর্বল ইমুনিটির কারণ ভাইরাল নিউমোনিয়া হতে পারে। 
  • ছত্রাক-জাত নিউমোনিয়ার হার অত্যন্ত কম। এই ধরনের ছত্রাকদের নাম - হিসটোপ্লাসম কাপ্সুলাটাম, ব্লাসটোমাইসেস, ক্রিপ্টোকক্কাস নিওফরমান্স ইত্যাদি। দুর্বল ইম্মুনিটির কারনে ছত্রাক থেকে নিউমোনিয়ার সংক্রমন হয়ে থাকে। 
  • বিভিন্ন পরজীবী থেকেও নিউমোনিয়া হতে পারে যেমন - ট্যাক্সোপ্লাসম্ গণ্ডী, স্ত্রোঙ্গিলইদেস স্তেরকরালিস, আস্কারিস লাম্ব্রিকইদেস ইত্যাদি। 

নিউমোনিয়ার সংক্রমণ ঘটাতে পারে এমন সাধারণ অসুস্থতাগুলি হল- 

  • সাধারণ সর্দিকাশি
  • কোভিড-19
  • ইনফ্লুয়েঞ্জা 
  • হিউম্যান প্যারাফ্লুয়েঞ্জা 
  • নিউমোকোকাল রোগ

ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়ার সংক্রমণ হসপিটাল, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র গুলি থেকেও ছড়াতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে অন্য রোগের চিকিৎসা করাতে এসে রোগীরা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। 

নিউমোনিয়া সংক্রমনের পদ্ধতি

এই রোগের সংক্রমন প্রধানত উচ্চ শ্বাস নালীতে হয়। শ্বাস যন্ত্রের এই অংশ শ্বাসনালী এবং ফুসফুস কে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর হাত থেকে রক্ষা করে। সংক্রমিত উচ্চ শ্বাসনালীর প্রতিরোধী ক্ষমতা কমে যায়। ধীরে ধীরে অপর থেকে শ্বাসনালীর নিম্নাংশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পরে। নিউমোনিয়ার সংক্রমণের মাত্রা জীবাণু সংক্রামক ক্ষমতার উগ্রতা (virulence), রোগীর ইমুনিটির অপর নির্ভর করে। কাশি ও হাঁচির সাথে সংক্রামিত রোগীর নাক এবং মুখ থেকে থেকে জীবাণুযুক্ত তরলের ক্ষুদ্র ফোঁটা (droplets) বাতাসে ছড়িয়ে পরে। অন্য কেউ প্রশ্বাসের সময় জীবাণুযুক্ত বাতাস গ্রহন করলে তার শরীরে সংক্রমন ছড়িয়ে পরতে পারে। এই জন্য নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের নাক-মুখ ঢেকে রাখতে বলা হয়। 

নিউমোনিয়া স্থায়ীত্বকাল

পূর্ণ সংক্রমনের পর সাধারণত নিউমোনিয়া 2 থেকে 3 সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী থাকে।

নিউমোনিয়া নিরাময়ের সময়কাল

সঠিক সময়ে এবং সঠিকভাবে চিকিৎসা করা হলে নিউমোনিয়া পুরোপুরি নিরাময় হতে 2 থেকে 3 সপ্তাহ লেগে যায়। তবে যদি রোগীর অবস্থা খারাপ থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে সেরে উঠতে এর থেকে বেশি সময় লাগতে পারে।

বয়স্ক মানুষদের (বিশেষ করে পঁয়ষট্টি বছরের বেশি বয়সীদের) এবং যাদের হার্ট, ফুসফুস, কিডনি বা স্নায়বিক দুর্বলতা যুক্ত মানুষদের সেরে উঠতে অনেকটা সময় লেগে যায়।

রোগীর ডায়াবেটিস থাকলে নিউমোনিয়া-জনিত সমস্যা বার তে পারে। 

কিছু বিশেষ রোগ (যেমন ক্যান্সার, আইচ আই ভি) ইমিউনিটি দুর্বল করে দেয়। এই ধরনের রোগী দের নিউমোনিয়া থেকে সেরে উঠতে বেশি সময় লাগে।

নিউমোনিয়া পরীক্ষা করার পদ্ধতি 

নিউমোনিয়ার সংক্রমণ এবং তার তীব্রতা নির্ণয় করার জন্য ডাক্তাররা বিশেষ কিছু ল্যাব টেস্টের নির্দেশ দেন। যেমন - 

  • ব্লাড কালচার
  • ব্লাড কাউন্ট
  • চেস্ট এক্স-রে
  • চেস্ট স্ক্যান
  • স্পুটাম কালচার 

নিউমোনিয়ার চিকিৎসা

সাধারণ নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় ফুসফুসে প্রদাহের তীব্রতা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। বাড়িতে থেকেই নিরাময় করা সম্ভব। রোগের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেলে ডাক্তাররা রোগী কে হসপিটালে ভর্তি করতে বলেন। প্রধান চিকিৎসা প্রণালী গুলি হোল - 

  • অ্যান্টি বায়োটিকের প্রয়োগ
  • কফ্ মেডিসিন ব্যবহার
  • জ্বরের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ
  • শ্বাস প্রশ্বাস এর হার অব্যাহত রাখা। দরকার হলে অক্সিজেন দিতে হয়।

নিউমোনিয়া প্রতিরোধের উপায়

নিউমোনিয়া প্রতিরোধের কার্যকরী উপায় গুলি হোল - 

  • ধুমপান বন্ধ করা। 
  • প্রাপ্ত বয়স্ক এবং শিশুদের ফ্লু ভ্যাক্সিন দেওয়া। 
  • ব্যবস্থা করতে পারেন বা ভ্যাক্সিন নিতে পারেন। 
  • নিউমোনিয়া হলে নাক ও মুখ মাস্কে ঢেকে রাখা।
  • ধোঁয়া ও ধুলো এড়িয়ে চলা। 
  • পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস। 

শিশুদের জন্য নিরাময়ের উপায় 

2 মাসের কম বয়সী শিশুদের জন্য নিউমোনিয়া ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। এই রকম ক্ষেত্রে নিউমোনিয়ার উপসর্গ দেখা দিলে রোগী কে দ্রুত হসপিটালে ভর্তি করা দরকার। এছাড়া অন্যান্য কর্তব্য গুলি হোল - 

  • শিশুদের সময় মতো নিউমোক্ককাস, হাম এবং হুপিং কাশি (পারটুসিস) টিকা দেওয়া। 
  • জীবনের প্রথম 6 মাস বুকের দুধ খাওয়ানো। এতে শিশুদের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
  • নিউমোনিয়া ধরা পরলে স্যুপ জাতীয় পানীয় খাওয়ান। এতে শরীরে জলে জোগান বজায় থাকে। 
  • কাশির ওষুধ সম্পর্কে ডাক্তারদের জিজ্ঞাসা করুন।
  • সঠিক সময়ে শিশুকে খাবার আর ওষুধ খাওয়ান।
  • হট কম্প্রেস করুন।
  • লবণাক্ত গরম জলের ভেপার নেওয়া।

নিউমোনিয়া রোগীদের খাবারের তালিকা

নিউমোনিয়ার সাথে লড়াই করার জন্য সুষম খাবার অত্যন্ত দরকার। শরীরে শক্তির জোগান বেশি প্রয়োজন। তাই কি খাওয়া উচিত তা নিচে দেওয়া হল -

  • সহজ পাচ্য কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন এবং চর্বি 
  • গরম দুধ 
  • নারকেলের জল, তাজা রস এবং বাটার মিল্ক বা ঘোল। 
  • পনির, ডাল, লেবুর মত খাবার। 
  • সবুজ শাক। 
  • গরম স্যুপ। 
  • টক দই জাতীয় প্রোবায়োটিক খাবার। 

কোন কোন খাবার এড়িয়ে চলা উচিত?

  • ঠাণ্ডা পানীয় 
  • ঠাণ্ডা খাবার 
  • খাবারে অতিরিক্ত লবণ
  • স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ট্রান্স ফ্যাট যুক্ত খাবার। 

উপসংহার

বিশেষ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে নিউমোনিয়া সাধারণত মারাত্মক হয়ে ওঠেনা। শিশু এবং বেশি বয়স্কদের অতিরিক্ত যত্ন নেওয়া দরকার। শীতকালের শুকনো আবহাওয়ায় নিউমোনিয়ার সম্ভাবনা বেরে যায়। তাই এই সময় শ্বাসনালী কে আর্দ্র রাখা খুবই জরুরী। এতে শ্বাসনালীতে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। এই রোগ সম্বন্ধে জানুন এবং লোক কে জানান। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।