Enquire now
Enquire NowCall Back Whatsapp
শিশুদের জন্মগত হৃদরোগের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

Home > Blogs > শিশুদের জন্মগত হৃদরোগের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

শিশুদের জন্মগত হৃদরোগের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

Pediatric Cardiology | by BMB | Published on 08/05/2023


জন্মগত হৃদরোগ ও তার চিকিৎসা

হৃদরোগ শুধু বয়স্কদেরই হয় না, শিশুদেরও হতে পারে। তবে সাধারণত তা জন্মগত ত্রুটির কারণে হয়। জন্মের আগে বা জন্মের পরে-পরেই শিশুর হৃদযন্ত্রে এই সমস্যা ধরা পড়তে পারে। অনেকসময় আবার জন্মগত হৃদরোগ কয়েক মাস পর কিংবা বড়বেলায় গিয়ে ধরা পড়ে। সমস্যাটি যখনই ধরা পড়ুক না কেন, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। কারণ অধিকাংশ হৃদযন্ত্রের সমস্যার চিকিৎসা রয়েছে।

জন্মগত হৃদরোগ কী?

জন্মগত হৃদরোগ হল হৃদযন্ত্র বা হৃৎপিণ্ডের গঠনগত ত্রুটি যা জন্ম থেকেই বিদ্যমান। এক্ষেত্রে নানা রকমের ত্রুটি থাকতে পারে। যেমন, হৃৎপিণ্ডের দেওয়ালে ছিদ্র থাকতে পারে আবার ভালভ বা কপাটিকার গঠনে সমস্যা থাকতে পারে। অনেকসময় রক্তজালির বিন্যাসে ত্রুটি থাকায় হৃদপেশীতে রক্তপ্রবাহে সমস্যা হয়। প্রতি ১০০০ শিশুর মধ্যে ৮-৯ জনের হৃৎপিণ্ডে গঠনগত ত্রুটি থাকে। সমীক্ষা বলছে, ২০১৫ সালে বিশ্বে প্রায় ৪৮.৯ মিলিয়ন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত ছিল।

জন্মগত হৃদরোগের প্রকার

জন্মগত হৃদরোগ মূলত দুই ধরনের- সায়ানোটিক ও নন-সায়ানোটিক।

সায়ানোটিক কনজেনিটাল হার্ট ডিজ়িজ়: এই সমস্যা গুরুতর ও জন্মের পরেই ধরা পড়ে যায়। এক্ষেত্রে শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ কমে শিশুর ত্বক, ঠৌঁট, নখ, জিভের রঙ নীলচে হয়ে যায়। শিশু খেতে পারে না, এমনকী মায়ের দুধ টানতেও সমস্যা হয়। নানা কারণে এটা হতে পারে। যেমন হৃৎপিণ্ডের বাঁ দিকটা যদি তুলনায় বেশ ছোট হয় (হাইপোপ্লাস্টিক লেফ্ট হার্ট সিনড্রোম) বা মহাধমনীর গঠন অসম্পূর্ণ থাকে (ইন্টেরাপটেড অ্যাওর্টিক আর্চ) তখন হৃৎপিণ্ড থেকে শরীরে পরিশোধিত রক্ত প্রবাহে বাধা হয়। আবার হৃৎপিণ্ডের ডান দিকে কপাটিকা বা ভালভের গঠনে ত্রুটি থাকার কারণে (পালমোনারি অ্যাট্রেসিয়া, ট্রাইকাস্পিড অ্যাট্রেসিয়া) ফুসফুসে রক্ত যাওয়ার পথেও সমস্যা হতে পারে। আবার হৃৎপিণ্ডের গঠনগত ত্রুটির জেরে অক্সিজেন শূন্য ও অক্সিজের পূর্ণ রক্ত মিশে বিপদ হতে পারে। যেমন, হৃৎপিণ্ডে দু’টির বদলে একটি মহাধমনী থাকলে এমন বিপর্যয় হতে পারে। সায়ানোটিক সমস্যাগুলিতে হৃৎপিণ্ডের দ্রুত সার্জারি করতে হয়। সাধারণত জন্মের এক মাসের মধ্যে সার্জারি করা হয়।

নন-সায়ানোটিক বা অ্যাসায়ানোটিক কনজেনিটাল হার্ট ডিজ়িজ়: এক্ষেত্রে শিশুদের গায়ের রং পরিবর্তন হয় না বা চট করে ধরা পড়ার মতো কোনও উপসর্গ থাকে না। দেড় থেকে দুই মাস পরে হয়তো দেখা গেল শিশুর ওজন বাড়ছে না, খাওয়া কমে যাচ্ছে, খাওয়ার সময় শিশু ঘেমে যাচ্ছে। তখন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে পরীক্ষা করে সমস্যাটি জানা যেতে পারে। অ্যাসায়ানোটিকের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল হৃৎপিণ্ডে ছিদ্র বা ফুটো। অনেকসময় বড়বেলা পর্যন্ত এই সমস্যা চাপা থেকে যায়, ধরা পড়ে না। কখনও আবার ছোটবেলা নিজে থেকেই ছিদ্রটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কোথায় ফুটোটি রয়েছে তার উপরে নির্ভর করে সমস্যাটি কতটা গুরুতর। অবস্থান অনুযায়ী এর প্রকারভেদগুলি হল- আট্রিয়াল সেপটাল ডিফেক্ট (হৃৎপিণ্ডের পেশীর দেওয়াল বা সেপটামে ফুটো), অ্যাট্রিওভেন্ট্রিকুলার ক্যানাল, পেটেন্ট ডাকটাস আর্টেরিওসাস, ভেন্ট্রিকুলার সেপটাল ডিফেক্ট। হার্টে ফুটো ছাড়া অ্যাসায়ানোটিক সমস্যার মধ্যে রয়েছে মহাধমনীর গঠনগত ত্রুটি। মহাধমনী সরু হওয়ার কারণে বা এর ভালভের ত্রুটির জন্য রক্ত প্রবাহে সমস্যা হতে পারে। পালমোনারি আর্টারি, যেটা হৃৎপিণ্ড থেকে ফুসফুসে রক্ত পাঠায়, সেটিও সরু হওয়ার কারণে সমস্যা হতে পারে।

জন্মগত হৃদরোগের লক্ষ্মণ

রোগীর বয়স, হৃদযন্ত্রে কতগুলো জায়গায় সমস্যা, তা কতটা গুরুতর ইত্যাদি অনুযায়ী লক্ষ্মণ ভিন্ন হয়। যেমন, সায়ানোসিসের ক্ষেত্রে ত্বক, জিভ, নখ নীলচে হয়ে যাওয়া প্রধান লক্ষ্মণ। তাই একে বলে ‘ব্লু বেবি সিনড্রোম’। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা নেমে যায় লক্ষ্যণীয় ভাবে। নন-সায়ানোসিসের ক্ষেত্রে অনেক সময় কোনও লক্ষ্মণই বাইরে থেকে নজরে আসে না। তবে, শ্বাসে সমস্যা, দম ফুরিয়ে যাওয়া, ক্লান্তি, দুর্বল নাড়ির গতি, অনেকক্ষণ ধরে ঘুম, ওজন না বাড়া ইত্যাদি লক্ষ্মণ সাধারণত থাকে জন্মগত হৃদরোগীদের। হার্টে ফুটো থাকলে অনেক সময় অস্বাভাবিক রক্ত প্রবাহের জন্য হৃৎপিণ্ড থেকে সাঁই সাঁই শব্দ শোনা যায় (হার্ট মুরমুর) স্টেথোস্কোপে।

জন্মগত হৃদরোগ নির্ণয়

জন্মের আগেই ফেটাল ইকোকার্ডিওগ্রাম করে ভ্রূণের হার্টে কোনও সমস্যা রয়েছে কি না জানা যায়। জন্মের পর সায়ানোটিকের ক্ষেত্রে ‘ব্লু-বেবি’ দের বাহ্যিক পর্যবেক্ষণ ছাড়া পালস্  অক্সিমেট্রিতে অক্সিজেন লেভেল পরিমাপ করে নিশ্চিত হওয়া যায় সমস্যাটি সম্পর্কে।

সাধারণ ভাবে হৃদযন্ত্রের সমস্যা নির্ণয়ে বুকের এক্স-রে, ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম, ইকো কার্ডিওগ্রাম করা হয়। করোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করে বোঝা যায় হৃদযন্ত্র ঠিক ভাবে রক্ত সঞ্চালন করতে পারছে কি না। প্রয়োজনে এমআরআই করে হৃদযন্ত্রের ছবি নেওয়া হয়।

জন্মগত হৃদরোগের চিকিৎসা

সব সমস্যারই যে চিকিৎসা দরকার, এমনটা নয়। কিছু জন্মগত হৃদরোগ নিজে থেকেই সেরে যায়। কিছু ক্ষেত্রে আবার ওষুধে উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে থাকে। অক্সিজেন থেরাপি করে উপকার মেলে অনেকের।

সমস্যা গুরুতর হলে সার্জারি করতে হয়। ক্যাথিটার দিয়ে ত্রুটির জায়গায় প্লাগ স্থাপন করা যায়। সায়ানোটিকের ক্ষেত্রে সাধারণত ওপেন হার্ট সার্জারি করতে হয়। কখনও আবার হার্ট ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট করতে হয়।

এককথায় বলা যায় জন্মগত হৃদরোগ সময়ে নির্ণয় করা ও তার চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি। নিজের বা সন্তানের হৃদযন্ত্রে কোনও সমস্যা হলে গড়িমসি না করে সবার আগে কার্ডিওলজিস্টের পরামর্শ নিতে হবে, যিনি জন্মগত হৃদরোগে বিশেষজ্ঞ। এই সমস্যাটি এমন যে, নিয়মিত মনিটরিং করা দরকার বা পর্যবেক্ষণে থাকা দরকার। হৃদযন্ত্রে ঠিক কী সমস্যা রয়েছে এবং তার জেরে কী হতে পারে সে সম্পর্কে সজাগ-সচেতন থাকতে হবে। তাহলেই আসন্ন বিপদ বা জটিলতা এড়ানো যাবে।

বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্নমালা

১) জন্মের আগে কী জন্মগত হার্টের রোগ ধরা পড়ে ?

ফেটাল ইকোকার্ডিওগ্রাফি করে গর্ভস্থ ভ্রূণের হার্টের সমস্যা রয়েছে কিনা জানা যায়। সাধারণত জন্মানোর ২০ সপ্তাহ আগে এই পরীক্ষা করা যায়। বড় কোনও হার্টের সমস্যা থাকলে ভ্রূণটি রাখা হবে কি না তা নিয়ে পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। নাহলে জন্মানোর পরের মুহূর্ত থেকেই শিশুর চিকিৎসা শুরু করা হয়।

২) জন্মগত হৃদরোগ কী সারানো যায়?

ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করতে পারলে সেরে ওঠা সম্ভব। সায়ানোটিক সমস্যায় অস্ত্রোপচার করতেই হয়। জন্মের মোটামুটি এক মাসের মধ্যে হয় মাইক্রোসার্জারি নয় ওপেন সার্জারি করে এটা সম্পন্ন হয়। পরবর্তীকালে জন্মগত যে হৃদরোগগুলি ধরা পড়ে তা মাইক্রোসার্জারি, ওপেন সার্জারিতে সারতে পারে। কখনও কখনও ওষুধে দিয়েও সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এককথায়, ঠিক সময়ে চিকিৎসা করলে জন্মগত হৃদরোগগুলি সারানো বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে, একটু সাবধানে থাকতে হবে। যারা জন্মগত হৃদযন্ত্রের সমস্যায় ভুগছে তাদের জ্বর বা সর্দিকাশি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বাস্কেটবল, ক্রিকেট বা এই ধরনের খেলা চলবে না।

৩) হার্টের ছিদ্র কী সারতে পারে?

হ্যাঁ, অনেকসময় ছোটবেলা নিজে থেকেও সেরে যায় আট্রিয়াল সেপ্টাল ডিফেক্ট। খুব ছোট ছিদ্র থাকলে চিকিৎসার দরকার পড়ে না, শুধু নিয়মিত পর্যবেক্ষণে থাকতে হয়। তবে পরবর্তীকালের জটিলতা এড়াতে বা ছিদ্র বড় হলে ওপেন সার্জারি করে ফুটোর জায়গায় প্যাচ লাগিয়ে দেন চিকিৎসকেরা। বড় কাটাছেঁড়া না করে রক্তজালিতে ক্যাথিটার প্রবেশ করিয়ে প্যাচ বা প্লাগ স্থাপন করেও হার্টের ফুটো সারানো হচ্ছে।

৪) জন্মগত হার্টের ত্রুটি হয় কেন?

সাধারণত জরায়ুতে ভ্রূণের বিকাশের সময় কোনও ত্রুটি থেকেই জন্মগত হৃদরোগের সমস্যা হয়। এই অস্বাভাবিকত্ব ক্রোমোজোমাল বা জিনগত হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মদ্যপান ও ধূমপান করলে তার প্রভাবে গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতি হতে পারে। এছাড়া গর্ভাবস্থায় মায়ের ভাইরাল ইনফেকশন, ডায়াবেটিস বা এই ধরনের কোনও অসুখ থেকেও সমস্যা হতে পারে। তবে এটি বংশগত সমস্যা নয়।

৫) জন্মগত হৃদরোগ থেকে কী কী শারীরিক জটিলতা হতে পারে?

জন্মগত হৃদরোগ পরবর্তীকালে বেশ কিছু শারীরিক জটিলতা ডেকে আনতে পারে। যেমন, হৃদযন্ত্রের গঠনগত ত্রুটি থেকে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন হতে পারে। হৃদযন্ত্র আর শরীরের চাহিদামতো রক্ত পাম্প করতে না পারলে কনজেসটিভ হার্ট ফেলিওর হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা হয় অনেকের। প্রসূতির জন্মগত হৃদরোগ থাকলে অ্যারিদমিয়া, হার্ট ফেলিওর এমনকী স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি থাকে। পালমোনারি হাইপারটেনশন থেকে হার্ট ফেলিওর হতে পারে। আর আছে সাডেন কার্ডিয়াক ডেথ, যেটা সাধারণত হৃদযন্ত্রে বৈদ্যুতির সঙ্কেতব্যবস্থার বিপর্যয়ে হয়।