Endocrinology | by Dr. Sudip Kumar Mukherjee | Published on 18/04/2023
আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় চিকিৎসা ক্ষেত্রে সচরাচর শুনে থাকা একটা শব্দ 'ব্লাড প্রেসার' বা 'রক্তচাপ'। এটি শুনতে যতটা সাধারণ, মানবদেহের উপর এর প্রভাব ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। এখন জানা যাক এই ব্লাড প্রেসার বা রক্তচাপ বিষয়টা আসলে কি?
মানবদেহে রক্তের মাধ্যমে সারা দেহের প্রতিটি কলা কোষে পুষ্টি-পদার্থ এবং ফুসফুস থেকে অক্সিজেন পৌঁছে যায় আবার সারা দেহের কলা কোষে সঞ্চিত দূষিত পদার্থগুলি এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড রক্তের মধ্য দিয়েই রেচন অঙ্গ ও ফুসফুসে ফিরে আসে।তাই সারা দেহে আমৃত্যু রক্ত সঞ্চালিত হতে থাকে।এই সঞ্চালন পর্বে ধমনী-প্রাচীরের ভিতরের গাত্রে রক্ত যে বল প্রয়োগ করে সেটিই হল রক্তচাপ।সুস্থ মানুষের রক্তচাপ একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকা উচিত। ক্লিনিকাল ডায়াগনোসিসের ক্ষেত্রে রক্তচাপের পরিমাপের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। নির্দিষ্ট সীমার বেশি হলে এক ধরনের অসুস্থতা এবং সেই সীমার কম হলে অন্য ধরনের শারীরিক অসুস্থতাকে নির্দেশ করে।
রক্তচাপ পরিমাপ করার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় থাকে প্রথমটি, সিস্টোলিক প্রেসার নামে পরিচিত- যা আপনার হৃদপিণ্ডের সংকোচনের সময় আপনার ধমনীতে রক্ত যে চাপ প্রদান করে তার পরিমাপ।এই মান সাধারণ সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে 120mm-Hg।দ্বিতীয়টি, হল ডায়াস্টোলিক প্রেসার- যা আপনার হৃদপিন্ডের শ্লথনের সময়কালে আপনার ধমনীতে রক্ত যে চাপ দেয় তার পরিমাপ। এটির মান সাধারণ সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে 80mm-Hg। তাই একজন সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক রক্তচাপের মাত্রা হল 120/80 mmhg।এখানে মনে রাখতে হবে প্রতিটি মানব দেহই অনন্য, এছাড়াও বয়স সহ অন্যান্য বিষয় রক্তচাপের সাথে যুক্ত, তাই এই মানের রকমফের হতে পারে। তাই আপনার ডাক্তারবাবুই আপনার রক্তচাপের সঠিক মাত্রা বলতে পারবেন।
আজকের দিনের দ্রুত জীবনযাপন পদ্ধতি এবং অনিশ্চিয়তার জন্য উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা খুবই বেড়ে চলেছে। আপনার বিভিন্ন কাজকর্মের উপরে আপনার শরীরের রক্তচাপ সারা দিনে বারবার পরিবর্তিত হয়ে থাকে। নিয়মিতভাবে রক্তচাপ পরিমাপ করা হলে উচ্চ রক্তচাপ (বা হাই ব্লাড প্রেসার) নির্ণয় করা যেতে পারে।আপনার রক্তচাপের মাত্রা যত বেশি হবে, আপনার হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের মতো অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার ক্ষেত্রে আপনার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। এক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।অবশ্যই ভাল যন্ত্র এবং দক্ষ টেকনিশিয়ান বা ডাক্তারবাবুকে দিয়েই রক্তচাপ পরীক্ষা করাবেন।
আধুনিক জীবনযাত্রার ইঁদুর দৌড়ে মানুষের স্ট্রেস বেড়েই চলেছে।এই স্ট্রেস হল উচ্চরক্তচাপ বা হাইপার টেনশনের অন্যতম কারণ।এছাড়া নানা ধরনের কনজেনিটাল রোগ, কিডনির অসুখ, ডায়াবেটিস, থাইরয়েডের সমস্যার জন্য হাইপারটেনশন হতে পারে।অনেকে একে হেরিডিটারি বলে দাবী করেন তবে তা এখনও প্রমাণিত নয়।
উচ্চ রক্তচাপের কারণে স্বাস্থ্যের অবনতি হয়।এটি আপনার হার্ট, ব্রেন, চোখ এবং কিডনির মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলির ক্ষতি করতে পারে।তাই শরীর সুস্থ রাখতে নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপের উপর নজর রাখুন এবং সঠিক মান বজায় রাখার জন্য সুষ্ঠ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।
আপনার ধমনীগুলির স্থিতিস্থাপকতা উচ্চ রক্তচাপ ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যেটা আপনার হার্টে রক্ত এবং অক্সিজেনের প্রবাহকে কমিয়ে দেয় এবং হৃদরোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে।এর ফলে-
মানুষের শরীরে উচ্চ রক্তচাপের ফলে মস্তিষ্কে রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহকারী ধমনী ফেটে যাওয়া বা ব্লকের সম্ভাবনা থাকে, যার ফলে স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে।মস্তিষ্কের কোষগুলি স্ট্রোক হওয়ার সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়। স্ট্রোক মানুষের বাকশক্তি, নড়াচড়া করার ক্ষমতা এবং অন্যান্য কার্যকলাপের ব্যাপারেও অক্ষমতা সৃষ্টি করতে পারে। স্ট্রোকের কারণে এমনকি আপনার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বিশেষ করে মাঝবয়সী ব্যাক্তিদের উচ্চ রক্তচাপের সাথে মস্তিস্কের কার্যকারিতা এবং ডিমেনশিয়ার প্রত্যক্ষ সংযোগ লক্ষ্য করা গেছে।
সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস অথবা উচ্চ রক্তচাপ কিম্বা দুটি একসাথে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিকে বাড়িয়ে তোলে।
অতিরিক্ত ওজন কমান এবং আপনার কোমর বরাবর যে ভিসেরাল ফ্যাট আছে সেটা সরাসরি উচ্চ রক্তচাপের সাথে যুক্ত, এর প্রতি নজর রাখুন।সেটিকে কমাবার জন্য নিয়ম করে ব্যায়াম করুন।খেয়াল রাখবেন ওজন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তচাপ প্রায়ই বেড়ে যায়।তাই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে-
তবে উচ্চ রক্তচাপ জনিত স্বাস্থ্য সমস্যার ক্ষেত্রে, অবস্থা বিশেষে নিয়ম মেনে ওষুধ সেবন করা আবশ্যক এবং অবশ্যই তা ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মেনে।
এক্ষেত্রে রোগীকে কিছু নিয়ম মেনে খাবার খাওয়া জরুরী।
খাওয়ার নুন হল সোডিয়াম ক্লোরাইড (Nacl) নুনের মধ্যে থাকা সোডিয়াম নামের উপাদানটির জন্য আমাদের শরীরে রক্তচাপ বাড়ে। তাই আমাদের কম পরিমাণে নুন খেতে হবে।প্রত্যেকদিন আমাদের খাবারের মধ্যে ১.৫ গ্রাম নুন খাওয়া যেতে পারে।সাধারণত চা চামচের অর্ধেকের বেশি কিন্তু পৌনে এক চামচের কম নুন খেতে হবে।
খাবারের মধ্যে নুনের পরিমাণ কম করার উপায়-
এ তো গেল উচ্চ রক্তচাপ জনিত সমস্যা ও তার প্রতিকার এবং নিয়ন্ত্রণের উপায়, কিন্তু এর বিপরীতে অর্থাৎ লো ব্লাড প্রেসারও কিন্তু স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকারক।তাই সে ব্যাপারেও আমাদের কিছুটা অবগত হওয়া প্রয়োজন।
যদি রক্তচাপ কমে যায় সেটাও কিন্তু ভাল লক্ষণ নয়।চোখে অন্ধকার দেখা, মাথা ঘোরার সাথে শারীরিক অস্বস্তি দেখা দিতে পারে। তাছাড়াও ডায়েরিয়া, অ্যানিমিয়া বা টিবি রোগের সম্ভাবনা থাকতে পারে।যদি আচমকা রক্তচাপ কমে যায় তাহলে নুন চিনির সরবতের পাশাপাশি খাবারে নুনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হতে পারেন।তবে দেরি না করে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।মনে রাখতে হবে হাই ব্লাড প্রেশারের মত লো ব্লাড প্রেশারও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে তাই এটাকে অবহেলা করা উচিত না।
সবশেষে বলে রাখা ভালো যে, শরীর থাকলে রোগও হবে কিন্তু চিন্তা বা আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, শুধু নিয়মিত রুটিন চেকআপ করুন এবং এন্ডোক্রিনোলজি ডাক্তারের পরামর্শ মেনে সঠিক স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখুন মধ্যে উদ্ভূত সমস্যা থেকে মুক্তি।